সর্বাধিক পঠিত
February 22, 2019 3:11 am
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির এই মুহুর্তের সবচেয়ে বড় খবর ইমরান খানের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া । একের পর এক অভিনব পদক্ষেপ নিয়ে নতুন রাজনীতির সুবাতাস নিয়ে আসলেও ইমরান খান এমন এক সময়ে পাকিস্তানের হাল ধরেছেন যখন পাকিস্তান অর্থনীতি ও রাজনীতি এই দুই ক্ষেত্রেই এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে । এই প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হল ক্রিকেটের কিংবদন্তী খান সাহেব কি পারবেন পাকিস্তানকে সঠিক পথে ফেরাতে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের একটু নিকট অতীতে ফিরে যেতে হবে । এবং পাকিস্তানের রাজনীতি এবং অর্থনীতির সাথে এখন কেবল পাকিস্তানই যুক্ত নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি এবং আমেরিকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের সাথে যুক্ত হয়ে গিয়েছে পাকিস্তানের ভাগ্যলিপি ।
আফগানিস্তানে আমেরিকা যুদ্ধ করছে প্রায় আঠারো বছর হয়ে গেলো ৷ এতো দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ আমেরিকা আগে আর কখনও করেনি। তাই প্রশ্ন করাই যায় এ যুদ্ধ থেকে আমেরিকা কি পেলো ! এই যুদ্ধের সাথে ইচ্ছা কি অনিচ্ছায় পাকিস্তানের জড়িয়ে যাওয়া এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে এক নতুন সংযোজন এবং পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থার বিশ্লেষণ আফগান যুদ্ধ ছাড়া সম্ভব নয় ।
২০০১ সাল থেকে , যখন তালেবান নেতা মোল্লা ওমর পাকিস্তান-আফগানিস্তান বর্ডার থেকে পালিয়ে গেলো তখন থেকেই পাকিস্তান আফগান তালেবানদের জন্য একটা অভায়রণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে । ওয়াশিংটনের বারবার নিষেধের পরেও পাকিস্তান আফগানিস্তানের তালেবান থেকে তার সমর্থন কমাচ্ছে না । এ প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি ডোনাল্ট ট্রাম্প বলেই দিয়েছে পাকিস্তান কে আর কোন সাহায্য নয় । ট্রাম্পের ঘোষণা যদি বাস্তব রূপ পায় তবে পাকিস্তান সৃষ্টি থেকেই অন্যতম বন্ধু আমেরিকা কে হারাতে যাচ্ছে । দেরিতে হলেও আমেরিকা বুঝতে শিখেছে যদি সে আফগানিস্তানে যুদ্ধ বন্ধ করতে চায় তাহলে অবশ্যই পাকিস্তানে অবস্থিত তালেবানদের উপরও নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে ৷
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার এক ভাষনে তো বলেই ফেলেছে যে পাকিস্তান অন্ধকার, নৈরাজ্য এবং ত্রাসের চর্চা করে ৷ প্রদীপের নীচে যে অন্ধকার আছে আমরা তো এতোদিন বুঝতেই পারে নি । শুধু আফগানিস্তান কে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে পাকিস্তানের ঝুঁকি আমলেই নেওয়া হয় নি । আর সে কারনেই পাকিস্তান হয়ে উঠেছে তালেবানদের অভয়ারণ্য । গত ১৫ বছরে আমেরিকা পাকিস্তান কে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার সাহায্য সহযোগিতা করেছ যা ট্রাম্পের মতে প্রায় জলে গেলো ।
পাকিস্তান কেন আফগানিস্তানের তালেবান নেতাদের সমর্থন করে তার জন্য পাকিস্তানের ভয়টা বুঝতে পারা অতীব জরুরী । ২০০১ সাল থেকে একেবারে যুদ্বের প্রায় প্রথম অংশ থেকেই ভারত আফগানিস্তান কে সাহায্য করে আসছে । তাদের সাহায্যের এই হাত পাকিস্তান কে ভয় পাইয়ে দিয়েছে । এটা হল একা হয়ে যাবার ভয়, কারন আফগানিস্তানকে বাদ দিলে দক্ষিণ এশিয়াতে পাকিস্তানের তেমন কোন বন্ধু নেই ।
আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটা সেটা হলো এর মূল সরকার খুবই দুর্বল এবং তালেবানদের হাতেও এমন কোন ক্ষমতা নেই যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসতে পারবে । এমনকি তালেবানদের ঠিক ঐ ক্ষমতাও নেই যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা কোন একটা শহর দখল করবে ৷ তাছাড়া যে সমস্যাটা সবচেয়ে প্রকট বলা যায় তা হলো আফগানিস্তানের মূল সরকার খুবই দুর্বল । পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এমনকি বাংলাদেশেও যে চেষ্টা করা হয় বিকেন্দ্রীকরণের কিন্ত আফগানিস্তানের প্রাদেশিক শাসকরা এতোই শক্তিশালী যে তাদেরকে দমানোর জন্য মূল সরকার কে শক্তিশালী করা অতীব জরুরী ৷
পাকিস্তানের আরেকটা সংকট হল জবাবদিহিতার । আমেরিকা পাকিস্তান কে অনেক লোন দিচ্ছে ঠিক কিন্ত এই লোন কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে এই জায়গাটাতে জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে । পাকিস্তানের প্রায় সব রাষ্ট্রপ্রধানরাই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত । তাই এমন অবস্থায় তাদেরকে জবাবদিহির সম্মুখীন করা সহজ কাজ নয়। সে প্রেক্ষাপটে আমেরিকার পক্ষ থেকে পাকিস্তানে মিলিটারি সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছে এবং অবস্থাসূত্রে বলা যায় এটা কোন অমূলক সিদ্ধান্ত নয় যে কোন সময় এ সাহায্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে ।
কেবল মিলিটারিই নয় বাণিজ্য, পরিবহণ, আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রশ্নে আমেরিকা দ্রুতই পাকিস্তানের ঘনিষ্ট মিত্রের লেবেল তুলে নিতে বদ্ধপরিকর।
তবে আমেরিকা পাকিস্তান কে সাহায্য দেওয়া বন্ধ করলেও পাকিস্তান খুব একটা সমস্যার সন্মুখীন হবে বলে মনে হয় না কারন পাকিস্তানের রয়েছে অন্যতম সহযোগী পার্টনার দেশ সৌদি আরব । পাকিস্তান সুন্নী ইসলামী দেশ হওয়ায় বরাবরই সৌদি আরবের সাহায্য সহযোগিতা পেয়ে থাকে ৷ এছাড়া ইরানের সাথে যেহেতু পাকিস্তানের একটা যোগসূত্র হওয়ার সম্ভাবনা আছে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সেটাও পাকিস্তানকে অণুকুল পরিবেশের দিকে নিয়ে যাবে।
আমেরিকা যদি পাকিস্তান কে সাহায্য করা বন্ধ করে দেয় তাহলে সম্ভাব্য যেটা হতে পারে তাহলো পাকিস্তান তার মিত্র হিসেবে চীন কে বেছে নিবে । আর আমেরিকার বর্তমান জায়গাটা চীন দখল করে নিবে । তার মানে যদি আমেরিকা আসলেই পাকিস্তানে সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দেয় এবং চীন আমেরিকা কে সাহায্য করা শুরু করে তাহলে রাজনীতিতে তৈরি হবে নতুন মেরুকরন অন্তত পাকিস্তান তাই মনে করে ।
তবে চীনের নতুন মন্তব্য কিন্ত অন্য ধরনের ইঙ্গিত দিচ্ছে । চীনের নতুন মন্তব্য ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এই মূহর্তে আমেরিকার সাথে চীন বড় কোন ধরনের সংঘাতে যেতে চাচ্ছে না কারন হলো এখানে অনেক বড় ধরনের বানিজ্য স্বার্থ জড়িত আছে । চীন সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানী করে আমেরিকায় । আমেরিকা হলো চীনের সবচেয়ে বড় বাজার তাই অহেতুক কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে চীন কোনভাবেই তার বাজার হারাতে চাইবে না ।
পাকিস্তানের উপর চীনও বিরক্ত কারন একটা কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে যে চীনের উইঘুরে মুসলিম বিদ্রোহীদের পাকিস্তানী তালেবানরা সাহায্য করছে আর এটা যদি হয়ে থাকে তাহলে আসলেই পাকিস্তানের জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে । এছাড়াও পাকিস্তানে কমর্রত চীনা শ্রমিকদের উপর বেশ কয়েকটা হামলা হয়েছে যা চীনের সাথে সম্পর্কে চিড় ধরাতে পারে ।
অন্যদিকে চীনের যখন পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে তখন চীনের আবার ভারতের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভালো হচ্ছে । ২০০২ সালে যখন ভারতের সাথে চীনের বছরে বানিজ্য হতো মাত্র দুই বিলিয়ন ডলার এখন দুই দেশের মধ্যে বানিজ্য সম্পর্ক প্রায় একশো বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে ।
তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বলা যায় পাকিস্তান বেশ রকমের বিপদেই আছে এর ভূ রাজনৈতিক , সামাজিক এবং পারস্পরিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক কারনে । পাকিস্তানের জন্য তাই সবচেয়ে কার্যকর এবং যুগপোযোগী সিদ্ধান্ত হবে তার আশেপাশের প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা ৷ তবে ভারত যেভাবে তার পাকিস্তানকে তার প্রতিবেশীদের সাথে আলাদা করার প্রকল্প নিয়ে রেখেছে সেখানে কতটুকু সামনে এগোতে পারবে পাকিস্তান তা এখনই বলা মুশকিল । ভারত ইতিমধ্যেই সার্ককে অকার্যকর করে বিমসটেকের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে নতুন সমীকরণ আঁটছে ।
তবে এই জায়গায় ইমরান খান সত্যিই পাকিস্তানের আশার আলো । কেননা ইমরানই প্রথম রাজনীতিবিদ যিনি গত আঠারো বছর ধরে আমেরিকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের সমালোচনা করে আসছে । ইমরান জনসভায় বারবার বলেছেন এই যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ । এতে পাকিস্তানের জনগণের সায় নেই এবং এটি স্পষ্টতই পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন । তাছাড়া ইমরান খান একেবারে হিসেব করে দেখিয়েছেন এই যুদ্ধে পাকিস্তানের ৭০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ও ৪০ হাজার পাকিস্তানির জীবন গিয়েছে।
ইমরান খানের এই বক্তব্যগুলো জনগণ খেয়েছে বলা যায় কারণ এর ভিত্তিতেই ভোটের রায় গিয়েছে ইমরান খানের প্রতি। এই অবস্থায় পাকিস্তানের দেউলিয়া অবস্থায় যদিও খানের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে তবুও এই নির্বাচন এবং এতে ইমরান খানের বিজয়ের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ হয়েছে যে পাকিস্তানের জনগণ আর যুদ্ধ চায় না, সেনাবাহিনীর অস্ত্রের ঝনঝনানি চায় না। জনগণ চায় শান্তি এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। এখন দেখার পালা ইমরান খানের পাকিস্তান কোনদিকে যায়।
Sanjida Bary is a student of Department of International Relations, University of Dhaka. She loves Novel, Animation movie and English music particularly die hard fan of Westlife and Pink flyod also a art enthusiastic. She basically fight for her every dream because she does’t know which one let you go make her complete.